বাংলাদেশে এখন গড়ে প্রতিবছর ৩০০ মানুষ বজ্রপাতে মারা যান
বাংলাদেশে গত এক দশকে বজ্রপাতের ঘটনা ও মৃত্যুর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। আবহাওয়া অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রতিবছর গড়ে ৩০০ মানুষ বজ্রপাতে প্রাণ হারান। চলতি বছরের এপ্রিল মাসেই নিহত হয়েছেন ৩০ জন। বিশেষজ্ঞরা এটিকে জলবায়ু পরিবর্তন ও পরিবেশগত বিপর্যয়ের ফল হিসেবে দেখছেন।
কেন বাড়ছে বজ্রপাতের ঝুঁকি?
১. উষ্ণায়ন ও পরিবেশ বিপর্যয়: বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির কারণে বজ্রমেঘের পরিমাণ ও তীব্রতা বেড়েছে। নাইট্রোজেনের মাত্রা বৃদ্ধিও বজ্রপাতকে প্রভাবিত করছে।
২. গাছপালা কাটা: গ্রামাঞ্চলে উঁচু গাছ (তাল, বাবলা) কেটে ফেলায় মাঠে কাজরত কৃষক, পথচারী ও গবাদি পশু সরাসরি বজ্রপাতের শিকার হচ্ছেন।
৩. ফসলি জমির ব্যবহার: একই জমিতে বহুবার ফসল চাষের কারণে কৃষকদের মাঠে থাকার সময় বাড়ছে, যা ঝুঁকি বাড়াচ্ছে।
ব্যর্থ প্রকল্প ও অকার্যকর উদ্যোগ
- তালগাছ রোপণ: ২০১৬ সালে ৪০ লাখ তালগাছ রোপণের প্রকল্প নেওয়া হয়েছিল, কিন্তু রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এটি ব্যর্থ হয়।
- লাইটনিং অ্যারেস্টার: কিছু অ্যারেস্টার বসানো হলেও ভুল স্থানে (যেমন: ওয়্যারলেস টাওয়ারের পাশে) স্থাপন ও রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এগুলো কার্যকর হচ্ছে না।
বর্তমান পদক্ষেপ ও বিশেষজ্ঞ পরামর্শ
- পূর্বাভাস ব্যবস্থা: আবহাওয়া অধিদপ্তর জাপানের স্যাটেলাইট ডেটা ও লাইটনিং ডিটেক্টরের মাধ্যমে ২-৪ ঘণ্টা আগে বজ্রপাতের সতর্কতা দিচ্ছে।
- সচেতনতা প্রচার: মোবাইল অপারেটরদের মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক সতর্কবার্তা পাঠানো হচ্ছে।
- অ্যারেস্টার প্রকল্প: দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তর দেশব্যাপী অ্যারেস্টার বসানোর পরিকল্পনা করছে, তবে এর স্থায়ী রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিত করা চ্যালেঞ্জ।
বিশেষজ্ঞদের হুঁশিয়ারি
- ড. ফেরদৌস আহমদ (পরিবেশ গবেষক): “মালয়েশিয়া বা যুক্তরাষ্ট্রে বজ্রপাত বেশি হলেও সচেতনতা ও অ্যারেস্টারের কারণে মৃত্যু কম। বাংলাদেশে গ্রামীণ অবকাঠামো দুর্বল হওয়ায় ঝুঁকি বেশি।”
- গওহার নাঈম ওয়ারা (দুর্যোগ বিশেষজ্ঞ): “প্রাকৃতিক প্রতিরোধক (গাছ) নষ্ট করায় বজ্রপাত সরাসরি মানুষের ওপর আঘাত করছে। মাঠের পাশে বাবলা-তালগাছ রোপণ জরুরি।”
বজ্রপাত থেকে বাঁচতে করণীয়
- বজ্রঝড়ের সময় উঁচু গাছ, বিদ্যুতের খুঁটি বা খোলা মাঠ এড়িয়ে চলুন।
- দ্রুত পাকা ঘরে আশ্রয় নিন।
- গাড়ির ভেতর থাকলে জানালা বন্ধ রাখুন।
- মোবাইল ফোন ব্যবহার ও ধাতব জিনিস স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।
দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রেজওয়ানুর রহমান জানান, “আমরা বজ্রপাতকে জাতীয় দুর্যোগ হিসেবে বিবেচনায় নিয়ে সমন্বিত উদ্যোগ নিচ্ছি। তবে সচেতনতাই এখন প্রধান হাতিয়ার।”
সম্পাদকীয় নোট:
বজ্রপাত মোকাবিলায় টেকসই পরিকল্পনা, গাছ রোপণ ও অ্যারেস্টারের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা জরুরি। পাশাপাশি, গ্রামীণ জনগোষ্ঠীকে সরাসরি প্রশিক্ষণ ও সম্পৃক্ত করলে মৃত্যুঝুঁকি কমানো সম্ভব।

