ব্যক্তি ও সমষ্টির বৈষম্য: বাংলাদেশের সমাজ-রাজনীতিতে একটি অনন্ত সংঘাত

সম্পাদকীয়

প্রবন্ধ: সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী
বিশেষ প্রতিবেদন, পাংশা সংবাদ

প্রাক-স্বাধীনতা থেকে স্বাধীনতা-পরবর্তী: ব্যক্তির উত্থানের ইতিহাস

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় ব্যক্তিস্বার্থ ও সমষ্টিকেন্দ্রিক মঙ্গলের মধ্যে টানাপোড়েন নতুন নয়। ১৯৪৫-৪৬ সালে ব্রিটিশবিরোধী তীব্র আন্দোলনের সময় প্রায়-বিপ্লবী পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল। তখনকার কৃষক-শ্রমিকদের গণজাগরণকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্রিটিশ ও স্থানীয় অভিজাতরা তড়িঘড়ি নির্বাচনের ডামাডোল সৃষ্টি করে। জনগণকে ঠেলে দেওয়া হয় সাম্প্রদায়িকতার গহ্বরে, যার পরিণতি ছিল ভয়াবহ দাঙ্গা ও দেশভাগ। এখানেই প্রথম ফুটে ওঠে “কতিপয়ের লাভের জন্য সমষ্টির বলি” হওয়ার নীতিটি।

১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, এবং ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিটি সংগ্রামেই লক্ষ্য ছিল সামষ্টিক মুক্তি। কিন্তু প্রতিবারই ক্ষমতার মঞ্চ দখল করেছে একদল ব্যক্তি বা গোষ্ঠী। মুক্তিযুদ্ধের পর সংবিধানে সমাজতান্ত্রিক মূল্যবোধের কথা লেখা হলেও বাস্তবে রাষ্ট্রীয় সম্পদ কুক্ষিগত হয়েছে কোটিপতি ব্যবসায়ী, আমলা ও রাজনীতিবিদদের হাতে। ১৯৭৫-এর পটপরিবর্তন, ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন, এমনকি ২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থানের পরও এই চক্রের পুনরাবৃত্তি থামেনি।


পুঁজিবাদ: বৈষম্যের স্থপতি ও মৌলবাদের জন্মদাতা

পুঁজিবাদী ব্যবস্থার মূলমন্ত্র হলো “যোগ্যরাই টিকে থাকবে”—যেখানে “যোগ্যতা” নির্ধারিত হয় অর্থ ও ক্ষমতার ভিত্তিতে। এই ব্যবস্থায় শ্রমিকের উদ্বৃত্ত মূল্য লুট করে তৈরি হয় মুনাফা, যা সমাজে বৈষম্য, দুর্নীতি ও হতাশার বীজ বপন করে। বাংলাদেশে পুঁজিবাদের বিকাশ ঘটেছে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায়। ব্যাংক লুট, শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি, বা বিদেশি ঋণের বোঝা—সবই সমষ্টির সম্পদ ব্যক্তির পকেটে পৌঁছানোর হাতিয়ার।

পুঁজিবাদের অন্ধকার দিক হলো মৌলবাদের উত্থান। আফগানিস্তানের তালেবানরা যেমন সিআইএ-এর অর্থে লালিত হয়েছিল সমাজতন্ত্রকে ধ্বংস করতে, তেমনি বাংলাদেশেও ধর্মীয় উগ্রবাদকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে জনগণের দাবিকে দমনে। লেখকের মতে, “পুঁজিবাদ ও মৌলবাদ দুই ভাই—একই মায়ের দুটি সন্তান, যার মা হলো ব্যক্তিস্বার্থের লালসা।”


নির্বাচন: গণতন্ত্রের মুখোশ নাকি ক্ষমতা বণ্টনের খেলা?

বাংলাদেশে “গণতন্ত্র” নামক শব্দটি বারবার অপব্যবহারের শিকার হয়েছে। ১৯৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট, ১৯৭০-এর নির্বাচন, বা ২০১৮-এর ভোট—প্রতিটি ক্ষেত্রেই নির্বাচন হয়েছে ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর বৈধতা অর্জনের হাতিয়ার। জনগণের ভোটাধিকারকে ঠেলে দেওয়া হয়েছে দলীয় স্বার্থের গহ্বরে। লেখকের ভাষায়, “নির্বাচন যদি জনগণের মুক্তির পথ হয়, তবে কেন প্রতি পাঁচ বছরে বাড়ে গরিবি, কমে শিক্ষা-স্বাস্থ্যের বরাদ্দ?”

২০০৮-এ প্রায় ৪০% মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকলেও ২০২৪-এ এই সংখ্যা কমেনি, বরং বৈষম্য বেড়েছে জিডিপি বৃদ্ধির সাথে সমানুপাতিক হারে। রেমিট্যান্সের অর্থ ঢুকছে সোনার গহনা ও ফ্ল্যাট কেনায়, তৈরি করছে নতুন ধনী শ্রেণি। অন্যদিকে, নিম্নমধ্যবিত্তের জীবনযাত্রার মান স্থবির।


মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বনাম বর্তমান বাস্তবতা: কোথায় হারালাম আমরা?

মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ছিল “সবার জন্য অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও ন্যায়বিচার”। কিন্তু আজ বাংলাদেশে:

  • অর্থনৈতিক বৈষম্য: শীর্ষ ১% মানুষের হাতে ১৬% জাতীয় আয়, নিচের ৫০% মানুষের হাতে মাত্র ২০%।
  • শিক্ষাব্যবস্থা: এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের বেতন বকেয়া, কোচিংবাণিজ্য আর নোট-গাইডের দৌরাত্ম্য।
  • স্বাস্থ্যসেবা: সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য “সিরিয়াল” কিনতে হয়, প্রাইভেট ক্লিনিকের দাপট।
  • আইনের শাসন: ধনী-গরিবের জন্য আলাদা বিচার ব্যবস্থা।

লেখকের জবানিতে, “১৯৭১-এ আমরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়েছিলাম, আজ লড়ছি স্বাধীন বাংলাদেশেরই এক শ্রেণির বিরুদ্ধে, যারা রাষ্ট্রকে বানিয়েছে লুটেরা ব্যবস্থা।”


সমাধানের পথ: সমষ্টির জয়গান

ইতিহাসের শিক্ষা হলো—ব্যক্তির উত্থান সমষ্টিকে ধ্বংস করে। তাই প্রয়োজন:

১. কাঠামোগত বিপ্লব

  • জমি সংস্কার: কৃষকদের হাতে জমির মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়া।
  • শিল্পনীতি: রাষ্ট্রীয় মালিকানায় ভারী শিল্প স্থাপন, যেখানে মুনাফা বণ্টিত হবে জনগণের মধ্যে।
  • শিক্ষার ব্যাপকীকরণ: বাণিজ্যিক শিক্ষার বদলে বৈজ্ঞানিক ও মানবিক শিক্ষার প্রসার।

২. সাংস্কৃতিক জাগরণ

  • মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ: কর্পোরেট মালিকানার বদলে গণমাধ্যমকে জনগণের হাতে ফেরানো।
  • সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলন: ধর্মনিরপেক্ষতাকে সংবিধানের মূল স্তম্ভ হিসেবে পুনঃস্থাপন।

৩. বৈশ্বিক সংহতি

  • পুঁজিবাদবিরোধী আন্দোলন: লাতিন আমেরিকার সমাজতান্ত্রিক অভিজ্ঞতা থেকে শেখা।
  • জলবায়ু ন্যায়বিচার: উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে ক্ষতিপূরণ আদায়।

উপসংহার: একটি প্রশ্ন, একটি সম্ভাবনা

লেখকের ভাষায়, “ইতিহাসের গতি উল্টো দিকে চালানোর চেষ্টা বৃথা। কিন্তু আমরা কি পারি না নতুন ইতিহাস তৈরি করতে? যেখানে ব্যক্তি নয়, সমষ্টিই হবে গৌরবের প্রতীক?” বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্মের হাতেই রয়েছে এই প্রশ্নের উত্তর। ১৯৭১-এ যেমন মিছিলে ছিল কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র, তেমনি আজকের সংগ্রামেও প্রয়োজন সমষ্টির জয়গান।


লেখক: ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *